আজকের এই সম্পাদকীয় কোনো প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি এবং এর অন্যতম প্রধান মূল্যবোধ সম্পর্কে। আমরা মনে করি, কোনো গণমাধ্যমকে নিষিদ্ধ করা উচিত নয়। কোনো প্রতিবেদনের নিম্নমান, তথ্যের ত্রুটি, সিদ্ধান্ত বা ব্যাখ্যা, কোনো কারণেই সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এই দাবি তোলা উচিত নয়।
একটি প্রতিবেদনে যাই বলা হোক না কেন তার উত্তর দেওয়া যেতে পারে কেবলমাত্র আরেকটি ভালো প্রতিবেদনের মাধ্যমে। যাতে থাকবে শক্তিশালী যুক্তি, অকাট্য প্রমাণ এবং পাঠকদের কাছে আরও সুন্দরভাবে তা তুলে ধরার চেষ্টা। কখনোই কোনো গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দাবি করা উচিত নয়। কারণ গণমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা স্বাধীন সাংবাদিকতার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। সাংবাদিকদের এমন দাবি অনেকটা গাছের ডালে বসে গোঁড়া কেটে দেওয়ার মতোই। ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র একমাত্র উত্তর হতে পারে নৈতিক ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা। ভুলগুলো ঠিক করুন এবং অন্যায়কারীকে লজ্জা দিন। এভাবেই মন্দ সাংবাদিকতাকে পেছনে ফেলে জয়ী হতে পারে ভালো সাংবাদিকতা।
যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের ধ্বংসকামী আল-কায়েদা এবং বিন লাদেনকে কেন এত বেশি কাভারেজ দিয়েছিল ইউরোপ-আমেরিকার গণমাধ্যমগুলো? ব্যাপারটি বিস্মিত করেছে অনেককেই। আল-কায়েদা এবং বিন লাদেনের প্রতিটি কথাই মিডিয়া প্রচার করেছে এবং প্রতিবেদনে সত্য তুলে ধরার মাধ্যমে তাদের প্রোপাগান্ডাগুলো সবার কাছে উন্মোচন করেছে, কিন্তু নিষিদ্ধ করেনি বা এড়িয়ে যায়নি। এমনকি আইএসের বিষয়েও একই কাজ করেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। অথচ তাদের সাংবাদিক ডেনিয়েল পার্লকে শিরশ্ছেদ করেছে এই জঙ্গি সংগঠনটি। পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমের কোনো ত্রুটি বা পক্ষপাত নেই, এ কথা বলা যায় না। তাদেরও ভুল আছে, তবে এর চেয়ে বেশি যা আছে তা হলো ভালো সাংবাদিকতার অনুশীলন।
সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা। যদি বলা হয় যে, আপনি যা ইচ্ছে বলতে পারেন, তবে তা আমার পছন্দ হতে হবে। যদি আমার পছন্দ না হয় তাহলে আর বলতে দেবো না। এ অবস্থায় কি কোনো স্বাধীনতা থাকবে?
সাংবাদিকতার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অন্যায়, মানহানি, তথ্যের বিকৃত প্রকাশ, এমনকি অসত্য তথ্যের বিষয়ে যে কারও আপত্তি করার অধিকার আছে। উৎকৃষ্ট সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমুচিত জবাব দেওয়ারও সুযোগ আছে।
আমরা চিন্তিত যে, সব সরকারই ‘দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা’র জন্য স্বাধীন গণমাধ্যমকে দায়ী করে এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
কয়েক দশক না হলেও বেশ কিছু বছর ধরে আমাদের গণমাধ্যমের একাংশ (যে দল ক্ষমতায় তার ওপর নির্ভর করে) জোর দিয়ে বলে যে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ইচ্ছাকৃত ও নিরলসভাবে আমাদের মানহানি করছে।
আমাদের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। মাথাপিছু আয় এক হাজার মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে প্রায় দুই হাজার ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত ১১ বছর ধরে আমাদের গড় জিডিপি বৃদ্ধির হার ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং এইচএসবিসি’র মতো বিশ্বের বৃহত্তম দুটি ব্যাংকসহ বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আমাদের চেনে সফল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে। কাজেই গণমাধ্যমসহ সব জায়গা থেকে আসা সমালোচনার সবচেয়ে ভালো এবং একমাত্র উত্তর হচ্ছে আমাদের উন্নতি।
নিকট ভবিষ্যতে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে সামিল হওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিরুদ্ধ মত এবং গণমাধ্যমের সমালোচনার প্রতি সহনশীল হতে শিখতে হবে আমাদের। আমাদের পরিপক্কতা এমন পর্যায়ে যেতে হবে যাতে ‘পক্ষপাতদুষ্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে আখ্যা পাওয়া রিপোর্টও আমরা সয়ে নিতে পারি। সেই সমস্ত রিপোর্ট যদি অসত্যই হয়ে থাকে তবে সেটা কখনই আমাদের কালিমা লেপন করতে পারবে না।
সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া কোনো কাজের কাজ হতে পারে না। আগেও কখনও কাজে আসেনি, আর এই আধুনিক যুগে আরও আসবে না। বরং এতে দেশ সম্পর্কে আরও বেশি অপ্রয়োজনীয় সমালোচনা জন্ম দেবে। কোনো কিছু নিষিদ্ধ করা হলেই তার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ে, পাঠক বাড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা হলেও তাতে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।
সূত্রঃ ডেইলি স্টার অনলাইন